যে দায়িত্ব মণ্ডলীর, তা যদি বাইরের কেউ গ্রহণ করে, তাহলে তা একটি গভীর নৈতিক ও আত্মিক সমস্যার জন্ম দেয়। অনেক সময় মণ্ডলী বা দাতা সংস্থা সদিচ্ছা নিয়ে এমন কিছু দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়, যা আসলে তাদের নয়। যেমন, যদি মণ্ডলী পরিবারের পরিবর্তে সন্তানদের বিশ্বাসগত গঠন বা শিষ্য গড়ে তোলার দায়িত্ব নেয়, তাহলে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতির—“বৈধ কর্তৃত্বের নীতি” বা Jurisdictional Principle—লঙ্ঘন ঘটে। এই নীতির মূল কথা হলো: ঈশ্বর যাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সেই দায়িত্ব পালনের অধিকার ও কর্তৃত্ব রয়েছে। অন্য কেউ যদি সেই দায়িত্ব, সদিচ্ছা নিয়েও, নিজের কাঁধে তুলে নেয়, তাহলে তা কর্তৃত্বের সীমালঙ্ঘন হয়ে দাঁড়ায় এবং শেষমেষ ক্ষতিই ডেকে আনে।
উদাহরণস্বরূপ, অনেক সময় নতুন দম্পতির সংসারে শ্বশুরবাড়ির অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ ঘটে—সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত, স্ত্রীর জীবনযাপন বা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে অনধিকার চর্চা করে। অথচ, বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রী একটি স্বাধীন ইউনিট; এই দাম্পত্য দায়িত্বে বাইরের হস্তক্ষেপ সীমিত থাকা উচিত। কিন্তু এভাবে বাইরের কর্তৃত্ব হস্তক্ষেপ করলে দম্পতির মধ্যে মতবিরোধ বাড়ে, দায়িত্বজ্ঞান হ্রাস পায়, এবং পরস্পরের প্রতি আস্থা দুর্বল হয়ে যায়।
মোশি ও তার শ্বশুর যিথ্রোর পরামর্শ (যাত্রাপুস্তক ১৮:১৩–২৬)
মোশি গোটা জাতির বিচারক হিসাবে একাই দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু তার শ্বশুর যিথ্রো পরামর্শ দেন, যেন মোশি যোগ্য লোকদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দিয়ে “বৈধ কর্তৃত্বের নীতি” অনুযায়ী কর্তৃত্ব ও সীমা দেন। এককভাবে সব দায়িত্ব নেওয়া ভারসাম্য নষ্ট করে ও নেতৃত্ব দুর্বল করে।
আরও একটি উদাহরণ হলো: কোনো বিদেশি মিনিষ্ট্রি বা দাতা সংস্থা যদি স্থানীয় মণ্ডলীর নেতৃত্ব বা কার্যক্রমে আধিপত্য বিস্তার করে—নির্দেশনা, পাঠ্যক্রম, কার্যক্রম, এমনকি সিদ্ধান্তগ্রহণেও প্রভাব বিস্তার করে—তবে স্থানীয় মণ্ডলী আত্মিক দিকনির্দেশ হারায় এবং ধীরে ধীরে বাইরের প্রোগ্রামের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই নির্ভরশীলতা তাদের আত্মবিশ্বাস, প্রাসঙ্গিকতা এবং নেতৃত্ব গঠনের ক্ষমতাকে খর্ব করে।
১ম শমূয়েলে (১৩:৮-১৪) বর্ণিত শৌল রাজা ভাববাদী শমূয়েলের জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই বলি প্রদান করে। যদিও বলি দেওয়া যাজকদের দায়িত্ব ছিল, তবু শৌল রাজকীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে যাজকীয় কাজ করেন। ফলে এখানে নীতি লঙ্ঘন হয়েছে- শৌল “বৈধ কর্তৃত্বের সীমা’ লঙ্ঘন করেন—একটি দায়িত্ব যা ছিল পুরোহিতের তা নিজের কাঁধে নেন, যা ঈশ্বর তাকে দেননি।
এই বৈধ কর্তৃত্বের নীতি ভঙ্গ হলে দুটি মারাত্মক দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত, প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধিত হয় না। বাইরের কার্যক্রম স্থানীয় চাহিদা ও সংস্কৃতি উপেক্ষা করে চাপিয়ে দিলে স্থানীয় নেতারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং আত্মিক নেতৃত্ব কেবল বাস্তবায়নকারী বা “middleman” হয়ে যায়। এর ফলে, সদস্যরা নিজেদের পালক বা নেতার প্রতি আস্থা হারায় এবং বাইবেলভিত্তিক আত্মিক দিকনির্দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গঠনের পথও রুদ্ধ হয়, কারণ যুব সমাজ নেতৃত্বের সাহস, দায়বদ্ধতা ও নিজস্ব কণ্ঠস্বর দেখতে পায় না। নেতাদের মনে “আমার কিছু বলার নেই” ধরনের এক নিরুৎসাহ মনোভাব জন্ম নেয়।
দ্বিতীয়ত, স্থানীয় মণ্ডলী উৎসাহ, সময় ও সম্পদ হারায়। কারণ বাইরের ধারণা বা কার্যক্রম স্থানীয় বাস্তবতা বুঝে না। এতে করে শিক্ষাপদ্ধতি ও কার্যক্রম স্থানীয় সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, প্রাসঙ্গিকতা হারায় এবং নতুন প্রজন্ম গীর্জাকে “বিদেশি ভাবনার বাহক” হিসেবে দেখে, যা তাদের বিচ্ছিন্ন করে তোলে। অনেক সময় বাইবেলীয় সত্যের জায়গায় অনুদানের শর্ত বা বাইরের মতবাদের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা বিশ্বাসের বিশুদ্ধতায় আঘাত হানে।
তাহলে প্রশ্ন হলো—যে মণ্ডলী নেতৃত্বে ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য সমাধান কী?
প্রথমত, ক্ষমতায়নমূলক অংশীদারিত্ব গঠন করতে হবে। বিনামূল্যে পাওয়ার মনোভাব বাদ দিয়ে এমন অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে, যা স্থানীয় নেতাদের সম্মান করে এবং তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমর্থন দেয়।
দ্বিতীয়ত, ছোট ছোট পদক্ষেপে আত্মনির্ভরতা গড়ে তুলতে হবে—ছোট বাজেট বা প্রকল্প হলেও মণ্ডলীর উচিত নিজস্ব প্রোগ্রাম নিজে চালানো শেখা। সদস্যদের সম্পদ, সময় ও প্রতিভা কাজে লাগাতে হবে এবং অনুদানের কার্যক্রমেও স্থানীয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
তৃতীয়ত, নেতৃত্ব উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে—বাইবেলভিত্তিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে Elder বা Lay Leader-দের ক্ষমতায়ন করতে হবে, যারা প্রাসঙ্গিক ও কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সম্মেলন ও সভাগুলোতেও স্থানীয় সংস্কৃতিজ্ঞানসম্পন্ন বক্তাদের ব্যবহার করতে হবে।
উপসংহার হিসেবে বলা যায়, বিদেশি সাহায্য বা অংশীদারিত্ব নিজে খারাপ নয়। কিন্তু যখন সেই সহায়তা স্থানীয় মণ্ডলীর কর্তৃত্বকে উপেক্ষা করে বা আধিপত্য স্থাপন করে, তখন তা নেতৃত্ব, আত্মিক পরিচয় ও সাংস্কৃতিক প্রাসঙ্গিকতায় মারাত্মক ক্ষতি করে। বিশেষ করে নেতৃত্ব ও অর্থনীতিতে দুর্বল মণ্ডলীর ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি অনেক বেশি। তবুও, বাইবেলভিত্তিক “বৈধ কর্তৃত্বের নীতি” অনুসরণ করে ধাপে ধাপে স্থানীয় নেতা ও মণ্ডলীকে ক্ষমতায়ন করা সম্ভব। বাইরের সাহায্য যেন সহযোগী হয়, শাসক নয়—এই দৃষ্টিভঙ্গি যদি গৃহীত হয়, তবে এমনকি দুর্বল মণ্ডলীর মধ্যেও আত্মিক পুনর্জাগরণ সম্ভব।
সারকথা: ঈশ্বর যাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তিনি চান সেই ব্যক্তি নিজে তা বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করুক। যদি সে দায়িত্ব না নেয় বা অন্য কেউ এসে সেই স্থান দখল করে নেয়, তাহলে মূল কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে পরিবার, মণ্ডলী ও সমাজজীবনে ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
বাইবেল বারবার দেখায় যে ঈশ্বর কর্তৃত্ব দেন দায়িত্ব পালনের জন্য, আধিপত্য বিস্তারের জন্য নয়। কর্তৃত্ব একটি দায়িত্বপূর্ণ আহ্বান—যা অবহেলা করা বা অন্যের কর্তৃত্বে হস্তক্ষেপ করা ঈশ্বর অপছন্দ করেন। কারণ, এটি তাঁর নির্ধারিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যায়।
এই নীতির প্রতি অবহেলা শুধু একটি ব্যক্তিকে নয়, বরং একটি পরিবার, একটি মণ্ডলী এবং কখনো কখনো একটি জাতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে।
তাই “বৈধ কর্তৃত্বের নীতি” বজায় রাখার মাধ্যমেই সম্ভব একটি আত্মনির্ভর, স্বাস্থ্যবান ও স্থায়ী মণ্ডলী বা নেতৃত্ব কাঠামো গড়ে তোলা। এটি ঈশ্বরের পরিকল্পনার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এবং আমাদের নেতৃত্বকে করে আরও বিশ্বস্ত, কার্যকর ও সম্মানজনক।
লেখকঃ ফ্রান্সিস কিশোর
ফ্রান্সিস কিশোর ২৬ বছর পূর্ণ সময় ঈশ্বরের জন্য কাজ করছেন। তিনি এ্যাসেমব্লীজ অব গড মণ্ডলী কর্তৃক স্বীকৃত একজন পালক ও চিলড্রেন ও ফ্যামিলি মিনিষ্ট্রি স্পেশালিষ্ট। বর্তমানে তিনি বিজয় মিনিষ্ট্রির পূর্ণ সময়ের পরিচালক হিসাবে কর্মরত আছেন।