যে ভালোবাসা আমাদেরকে যুক্ত করে
যোহন ১৯:২৫–২৭
ভূমিকা
যীশু যখন ক্রুশের উপর ছিলেন, তখন তিনি শুধু কষ্ট সহ্য করেননি—তিনি ঈশ্বরের হৃদয়ের গভীর ভালোবাসাও প্রকাশ করেছেন।
তিনি যেসব কথা বলেছিলেন, তৃতীয় বাণীটি আমার হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
তৃতীয় বাণী:
“হে নারী, দেখো তোমার ছেলে… ছেলে, দেখো তোমার মা।” (যোহন ১৯:২৬–২৭)
এটি দেখায়, যীশু কতটা অন্যদের যত্ন করতেন, এমনকি তাঁর সবচেয়ে কষ্টের সময়েও।
এই বাণীটির মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি—যীশু আমাদেরকে একটি নতুন পরিবার ও সমাজে একত্রিত করেছেন।
তৃতীয় বাণী – যে ভালোবাসা আমাদেরকে যুক্ত রাখে (যোহন ১৯:২৫–২৭)
- যন্ত্রণার মধ্যেও ভালোবাসা
যীশু কীভাবে কষ্ট সহ্য করেছিলেন তা একবার ভাবুন—
- যীশুর মমতা আমাদেরকে মুগ্ধ করার আগে, আমাদের বোঝা দরকার তিনি কী ভয়ংকর শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক কষ্ট সহ্য করেছিলেন।
১৯৮৬ সালে আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন একটি গবেষণা প্রকাশ করে যার নাম ছিল “The Physical Death of Jesus Christ” (যীশুর শারীরিক মৃত্যু)। এতে ইতিহাস, চিকিৎসা ও বাইবেলের তথ্য একত্রিত করে তাঁর মৃত্যু বিশ্লেষণ করা হয়। সেখানে যা বলা হয়েছে:
- লূক ২২ অধ্যায়ে লেখা আছে, যীশুর ঘাম রক্তের ফোটা হিসাবে ঝরেছিল। এটি একটি বিরল শারীরিক অবস্থা, যাকে বলে হেমাটিড্রোসিস।
- এটি ঘটে অতিরিক্ত মানসিক চাপে, যখন শরীরের ছোট রক্তনালীগুলো ফেটে গিয়ে ঘামের সঙ্গে রক্ত মিশে যায়। এটি প্রমাণ করে ক্রুশের আগেই যীশু কতটা মানসিক চাপে ছিলেন।
- যীশুকে ধরার পর বিচারের নামে তাকে নির্মম যন্ত্রণা দেওয়া হয়েছে, সেই রাতে বেশ কয়েক কিলোমিটার তাঁকে হাটানো হয়েছে
- তাঁকে খুব ভয়ংকরভাবে বেত্রাঘাত করা হয়েছিল:
- লোহার বল ও ধারালো হাড়যুক্ত বেত দিয়ে পিঠে মারলে তাঁর চামড়া ছিঁড়ে গিয়ে খসে খসে পড়েছে।
- রক্তনালী, পেশি এমনকি ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গও দেখা যাচ্ছিল।
- সাধারণত এত মার খেয়ে কেউ টিকতে পারে না।
- যীশুকে এতটাই মারধর করা হয়েছিল যে, যিশাইয় ৫২:১৪ বলেছে, “তাঁর চেহারা এমনভাবে বিকৃত হয়েছিল যে, কোনো মানুষের মতো আর তাঁকে মনে হয়নি।”
- তাঁর মাথায় ২-৩ ইঞ্চি লম্বা কাঁটার মুকুট ঠেসে পরানো হয়েছিল, যা মাথার গভীরে গিয়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা তৈরি করেছিল।
- এত কিছুর পরেও, তাঁকে নিজেই তাঁর ক্রুশ বহন করতে বলা হয়েছিল, যতক্ষণ না তিনি রাস্তার মাঝখানে পড়ে যান।
- ক্রুশবিদ্ধ হওয়া ছিল সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ও যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুদণ্ডঃ
- তাঁর হাত ও পায়ে প্রায় ৮ ইঞ্চি লম্বা পেরেক মারা হয়।
- এই পেরেকগুলো নার্ভ ভেদ করে তীব্র ব্যথা ছড়িয়ে দেয় সারা শরীরে।
- নিঃশ্বাস নিতে হলে যীশুকে পায়ের উপর ভর দিয়ে উপরে উঠতে হতো, তখন তাঁর ছিঁড়ে যাওয়া পিঠ কর্কশ কাঠে ঘষা খেত।
- মৃত্যুর পর এক রোমীয় সৈন্য তাঁর পাঁজরে বর্শা ঢুকায়:
- তখন রক্ত ও পানি সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, এটি পারিকার্ডিয়াল ও প্লুরাল ইফিউশন—যা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ থেকে হার্ট ফেইলর হয়ে থাকার চিহ্ন।
তাহলে প্রশ্ন হলো, এত কষ্টের মাঝেও যীশু কী করলেন?
এই ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার মধ্যে যীশু ক্রুশে ঝুলছিলেন, সেই চরম কষ্টের মধ্যেও তিনি এক অসাধারণ দৃশ্য তৈরি করলেন—তাঁর চোখে পড়ল, পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর মা মরিয়ম এবং প্রিয় শিষ্য যোহন। তিনি তাঁর নিজের মায়ের খেয়াল রাখলেন। বললেন…
“হে নারী, এই তোমার ছেলে। ছেলে, আর এই তোমার মা।”
ক্রুশের যন্ত্রণার মধ্যে নজীর বিহীন ভালোবাসা
- যন্ত্রণার মাঝেও যীশুর মন পড়ে রইল তাঁর মায়ের প্রতি।
- শারীরিক কষ্ট তাঁকে থামাতে পারেনি। তিনি ভাবলেন, মায়ের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও সঙ্গ কে দেবে? তখনই তিনি মরিয়মকে যোহনের জিম্মায় দিলেন, যেন যোহন তাঁর সন্তানের মতো মায়ের যত্ন নেন।
- বাইবেল পণ্ডিতরা মনে করেন, সেই সময়ে যোসেফ (যীশুর পালিত পিতা) আর জীবিত ছিলেন না। ইহুদি রীতি অনুযায়ী, পরিবারের বড় ছেলে বিধবা মায়ের দায়িত্ব নিত। যীশু সেই রীতিই পালন করলেন, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্তও দায়িত্বশীল পুত্র হয়ে তিনি অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।
এখানে দেখা যায়—
যন্ত্রণার মাঝেও যীশুর ভালোবাসা ছিল নিঃস্বার্থ, লক্ষ্য ছিল তাঁর মায়ের নিরাপত্তা।
এই ঘটনা আমাদের শেখায়:
- আসল পরিবার শুধু রক্তের নয়, বিশ্বাসেরও হয়।
- আমরা যখন যন্ত্রণায় থাকি, তখনও অন্যের মঙ্গল চিন্তা করা সম্ভব—এবং সেটাই খ্রীষ্টিয় ভালোবাসার প্রকৃত চিত্র।
- কেন তিনি ভাইদের দায়িত্ব দিলেন না?
- যীশুর সৎ ভায়েরা তখনও বিশ্বাসী ছিলেন না (যোহন ৭:৫)
- যোহন, প্রিয় শিষ্য, তখন ক্রুশের পাশে ছিলেন।
যীশু এমন একজনের হাতে মাকে তুলে দিলেন, যার সাথে যীশুর সম্পর্ক ছিল আত্মিক/বিশ্বাসের, রক্তের সম্পর্ক নয়।
এখানে প্রশ্ন হচ্ছে…
৩. “হে নারী” বলাটা কি মায়ের প্রতি অসম্মান ছিল না?
- যীশু যখন তাঁর মাকে “নারী” বলে সম্বোধন করেন, সেখানে কোনো অবমাননা বা অসম্মান ছিল না। বরং “নারী” (Woman) শব্দটি তখনকার কালে সম্মানের সাথে ব্যবহৃত হতো। যীশু কান্না নগরে বিয়ের অনুষ্ঠানেও মাকে “হে নারী” বলেছিলেন (যোহন ২:৪)।
- মূল গ্রিক ভাষায় “নারী” শব্দটি ছিল অত্যন্ত সম্মানসূচক ও আন্তরিকতাপূর্ণ একটি শব্দ।
- অ্যাম্পলিফায়েড বাইবেল এটি অনুবাদ করেছে “[প্রিয়] নারী” হিসেবে।
- মূল গ্রিক ভাষায় “নারী” শব্দটি ছিল অত্যন্ত সম্মানসূচক ও আন্তরিকতাপূর্ণ একটি শব্দ।
- যীশু যখন বললেন, “হে নারী, এই তোমার পুত্র,” তিনি মূলত মরিয়মকে আহ্বান করলেন যেন তিনি যোহনকে এখন নিজের পুত্রের মতো গ্রহণ করেন।
- যীশু শারীরিকভাবে তাঁর মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন, কিন্তু যোহন যেন সেই স্থানটি পূরণ করে, সেই দায়িত্বই তিনি তাঁকে দিলেন।
৪. নতুন পরিবার, নতুন কমিউনিটি
“এরপর থেকে সেই শিষ্য (যোহন) মাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান।” (যোহন ১৯:২৭)
এখানে শুধু তিনি তার মায়ের জন্য দায়িত্ব পালন করেন নি বরং তার পেছনে রয়েছে এক গভীর প্রতীকী এবং আত্মিক অর্থ— এটি শুধু পারিবারিক দায়িত্ব পালন করার বিষয় নয়—এটি একটি নতুন আত্মিক পরিবারের জন্ম দেওয়ার মুহূর্ত।
“যাঁরা তাঁকে গ্রহণ করলেন, তিনি তাঁদের ঈশ্বরের পরিবারে অন্তর্ভুক্ত হবার অধিকার দেন।” – যোহন ১:১২
- যীশু ক্রুশে যখন মারা যাচ্ছেন, তখনই নতুন এক বিশ্বাসের পরিবার শুরু হচ্ছে।
- এই পরিবার তৈরি হয়েছে বিশ্বাসে, ভালোবাসায়, ও দায়িত্বে। আত্মিক পরিবার
- ক্রুশের পাদদেশে একটি নতুন পরিবার
- এই ক্রুশেই জন্ম নিল মণ্ডলী—বিশ্বাসীদের পরিবার।
- এখন থেকে ঈশ্বরের লোকেরা আর শুধু রক্তের সম্পর্কে নয়, খ্রীষ্টে বিশ্বাসের দ্বারা পরিচিত হবেন।
- যীশুর রক্তশ্রোতে গড়ে উঠলো এক নতুন আত্মিক পরিবার।
- যীশু তাঁর গভীর যন্ত্রণার মাঝেও আমাদের শিখিয়েছেন—আমরা যেন একে অপরের যত্ন নিই।
ক্রুশ কেবল পরিত্রাণের প্রতীক নয়—
এটি বিশ্বাসের একটি নতুন পরিবার গঠনের স্থান, যার শিকড় ভালোবাসা ও দায়িত্বে গাঁথা।
- এই পরিবার তৈরি হয়েছে বিশ্বাসে, ভালোবাসায়, ও দায়িত্বে। আত্মিক পরিবার
গালাতীয় ৬:১০ — “…আমরা যেন সবাইকে উপকার করি, বিশেষ করে যারা বিশ্বাসী পরিবারের সদস্য।”
- আমরা কি আমাদের চার্চ বা বিশ্বাসীদেরকে সত্যিকার পরিবার মনে করি?
- আজ আমাদের চারপাশে এমন কে আছেন যার ভালোবাসা বা সাহায্য দরকার?
উপসংহার:
ক্রুশ – যেখানে ভালোবাসা ও ন্যায়বিচার একত্রিত হয়েছে।
- যীশু একটি নতুন পরিবার ও সামাজ তৈরি করলেন যা আমাদের রক্তের সম্পর্কে নয় বরং বিশ্বাসের দ্বারা স্থাপিত। আত্মিক পরিবার
- তাঁর মৃত্যুতে একটি নতুন সমাজ/কমিউনিটি শুরু হলো
—যেখানে আমরা ঈশ্বরের সন্তান, এবং একে অপরের ভাই-বোন।
- যীশু ক্রুশে যখন মারা যাচ্ছেন, তখনই নতুন এক বিশ্বাসের পরিবার শুরু হচ্ছে।
লেখকঃ ফ্রান্সিস কিশোর